ফুটপাতে স্কুলের পোশাক পরা ভাইরাল ছবির মরিয়ম-হাছনার গল্প
১০-১২ দিন আগে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল স্কুলের পোশাক পরা দুটি শিশুর ছবি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছিল স্কুলের পোশাক পরা দুটো মেয়েশিশু। একটি শিশু মুখে কিছু মাখছে। আরেকটি শিশুর চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছেন একজন নারী। পাশে ছড়ানো পলিথিনের ওপর বিছানা পাতা। মাদুর-কাঁথা-বালিশ। তার পাশে প্লাস্টিকের পানির বোতল, স্যান্ডেল ইত্যাদি। ছবি দেখলেই বোঝা যায়, ছবির তিনজনের বসবাস এই ফুটপাতেই।
এ শহরে ফুটপাতে সংসার পাতার দৃশ্যে চোখ অভ্যস্ত। তবে সেই সংসারে মলিন, জীর্ণ মানুষই বেশি চোখে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার জন্য শিশুর প্রস্ততি চোখে পড়ে না। নাগরিক জীবনের সব সুবিধাবঞ্চিত ও নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে থাকা শিশু দুটোকে দেখে যেমন খারাপ লাগছিল, তেমনি ইচ্ছা করছিল এই অদম্য ইচ্ছাশক্তির শিশুদের একবার দেখে আসতে!
ভাইরাল সেই পোস্টের কমেন্ট দেখে জানলাম, রাজধানীর পলাশীর মোড়ের পাশের কোনো ফুটপাতে থাকে এই শিশুরা। ১০ অক্টোবর শুক্রবার ছবির পেছনের দেয়ালচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে খুঁজে পেলাম তাদের থাকার জায়গা। গিয়ে দেখি, তাদের বিছানাপত্র গুছিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল ছবির সেই নারীকে। আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানা গেল, ওই নারীর নাম হামিদা বেগম (৪৫)। শিশু দুটির একটি তাঁর মেয়ে, অপরটি নাতনি। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো বাধার মুখে পড়তে হলো। হামিদা বেগম রেগে গেলেন। কথা বলবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিলেন। রাগান্বিত হয়ে ফুটপাতের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত দ্রুতগতিতে পাঁয়চারি করতে লাগলেন। গজগজ করতে করতে বলছিলেন, ‘৪০ বছর ধইরা এই ফুটপাতে আছি। এদ্দিন পর সাংবাদিক আসে, এ আসে ও আসে। এত দিন কই ছিলে এরা?’
হামিদা বেগমের রাগ দেখে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম তাঁর রাগ কমা পর্যন্ত কী অপেক্ষা করব, নাকি চলে যাব। হামিদা বেগমের রাগ কমার কোনো লক্ষণ না দেখে সেদিনের মতো ফিরে এলাম। তবে দমে গেলাম না! হামিদা বেগমের ক্ষোভ তো অমূলক নয়। সেদিন নামও জানা হলো না শিশু দুটির।
এবার জানা হলো ওদের নাম ও স্বপ্নের কথা
দ্বিতীয় দিন ১২ অক্টোবর রোববার দুপুরে হামিদা বেগমের ফুটপাতের সংসারে গিয়ে আবারও তাঁর ক্ষোভের মুখে পড়তে হলো। তবে এবার তাঁর রাগ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তিনি কাছে ডেকে নিয়ে কথা বললেন। তবে কীভাবে ঢাকায় এলেন, কী করতেন, কী করেন, কয় ছেলেমেয়ে—ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে চাপাচাপি করা সমীচীন মনে হলো না। তিনি যতটুকু বলতে চান, ততটুকুই শোনা হলো।
শিশু দুটির নাম মরিয়ম (৯) ও হাছনা (৬)। হাছনা হামিদা বেগমের মেয়ে আর মরিয়ম তাঁর নাতনি। মরিয়মের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তার মা মারা যান। মরিয়মের মায়ের মৃত্যুর আগেই বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। বাবা কখনো মরিয়মের খোঁজ নেন না। নানির কাছেই বড় হচ্ছে মরিয়ম। কথা বলার সময় স্কুল থেকে ফিরে মরিয়ম ও হাছনা দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। কাছের এক হোটেল থেকে খাবার কিনে আনা হয়েছে। মেন্য—ভাত আর শুঁটকিভর্তা।
হামিদা বেগম জানান, মরিয়ম ও হাছনা দুজনেই পড়ে পলাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মরিয়ম বলে, ‘আমি পড়ি বড় ওয়ানে আর অয় (হাছনা) পড়ে ছোট ওয়ানে।’ তাদের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া গেলেও এরপরও পড়াশোনা করতে চায় তারা। মরিয়ম বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চায়। আর হাছনা যোগ দিতে চায় সেনাবাহিনীতে। হামিদা বেগমের ইচ্ছা, তাঁর মেয়ে ও নাতনি পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হোক। হামিদা বেগম বলেন, ‘আমরা বাবা ৪০ বছর রাস্তায় থাকি। কাউয়ার (কাক) মতো এই রাস্তা থেকে ওই রাস্তায় যাই। চাউল আনি, ভাঙা ডিম (কম দামে পাওয়া যায় বলে) আনি, এডি রান্না করে খাই। ওদের আমি অনেক বড় করুম, এই জন্য স্কুলে ভর্তি করাইছি।’
পলিথিনের ওপর মাদুর আর কাঁথা বিছিয়ে থাকেন তাঁরা। কষ্ট পেতে হয় রোদ, বৃষ্টি, ঠান্ডায়। ইট জড়ো করে চুলা বানিয়ে রান্না করেন কখনো, আবার কখনো হোটেল থেকে কিছু কিনে খান। না খেয়েও থাকতে হয় কখনো কখনো। দূর থেকে পানি এনে গোসল করতে হয় তাঁদের। হামিদা বেগমের স্বামী অন্যের ফলের ভ্যানে ফল বিক্রির কাজ করেন। দিনে রোজগার হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। এই টাকায় চলে তাঁদের চারজনের পরিবার।
ওই ফুটপাতে শুধু মরিয়ম আর হাছনাই নয়, রয়েছে আরাফাত (৭), আমান (৬) ও রাইসা (৩)। শেষের এই তিন শিশুর বাবার নাম রাকিব, মায়ের নাম পাখি। রাকিব রিকশা চালান। এই ফুটপাতে পরিবার নিয়ে আরও থাকেন মসকুদ আলী। তিনি ভাঙারির দোকানে কাজ করেন। তিনি জানান, তাঁর নাতি সাইফের বয়স চার বছর। এই পরিবারগুলোও তাঁদের শিশুদের মরিয়ম ও হাছনার মতো স্কুলে পাঠাতে চায়। অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বলেন, আসছে শীতে কাজের খোঁজে এই ফুটপাতে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবে আরও কয়েকটি পরিবার। হয়তো সেই পরিবারেও শিশু থাকবে। ওই পরিবারগুলোও হয়তো তাদের সন্তানদের স্বাভাবিক একটি জীবনের স্বপ্ন দেখবে। সেসব স্বপ্নপূরণের পথ কেউ তৈরি করে দেবে কি না, কে জানে!
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শিরোনামের জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, জরিপে অংশ নেওয়া পথশিশুদের ৩০ শতাংশ খোলা জায়গায় থাকে, ৩৬ শতাংশ কখনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি। ৯১ শতাংশ পথশিশু কাজে যুক্ত। দেশের আট বিভাগের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ পথশিশুকে জরিপে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়। এই শিশুদের ৪৯ শতাংশ ঢাকায় থাকে।
Post a Comment